তারেক শামসুর রেহমান:
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি চলে গেলেন। ৮৪ বছরের জীবনে তিনি অনেক কিছু পেয়েছেন, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও ভারতের রাষ্ট্রপতির পদসহ। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটি সম্ভাবনাও তার ছিল। কিন্তু ‘হিন্দি বলয়ের রাজনীতির’ কারণে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি।
ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি চিরচেনা রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তবে একজন সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে গত কয়েক বছর তিনি তার ভূমিকা পালন করে গেছেন।
গেল বছরের এই আগস্ট মাসেই ভারতের সর্বোচ্চ পদক ভারতরত্নে তাকে সম্মানিত করেছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। তিনি কট্টর কংগ্রেসবিরোধী বিজেপি নেতাদের কাছেও সমান গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তার দীর্ঘ কংগ্রেসীয় রাজনীতি বিজেপি নেতাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি কখনও। একজন স্বচ্ছ রাজনীতিবিদের সফলতা এখানেই।
একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল তার। ইন্দিরা গান্ধীই তাকে রাজনীতিতে প্রথম ব্রেক দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এই ‘বাঙালি বাবুর’ সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা ও দক্ষতায় আস্থা রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আর এর প্রতিদান হিসেবেই ১৯৭৩ সালে তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। সেই থেকেই তার যাত্রা শুরু। পেছনে আর তাকাতে হয়নি। একজন সফল মন্ত্রী এবং সর্বশেষ একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জি বারবার আলোচিত হবেন।
বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তিনি বরাবরই আলোচনায় ছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল তার ‘আত্মার’ সম্পর্ক। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির আদি বাড়ি নড়াইলে। তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন তার পৈর্তৃক ভিটা দেখে যেতে ভোলেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করতেন (১৯৭৫-৮১), তখন প্রণব মুখার্জি আর তার স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রণব মুখার্জি ছিলেন তার প্রিয় ‘কাকা বাবু’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণব মুখার্জির পরিবারের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। ২০১৫ সালে শুভ্রা মুখার্জি প্রয়াত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন সমবেদনা জানাতে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া ও সাহায্য করার ব্যাপারে প্রণব মুখার্জি ছিলেন সক্রিয়। অনেক বাংলাদেশি রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও সখ্য ছিল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নত করার ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন বাংলাদেশের পাশে। তিনি চেষ্টা করেছেন তার অবস্থানে থেকে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৩ সালের মার্চে।
সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের পর কোনো ভারতীয় রাষ্ট্রপতির প্রথম বাংলাদেশ সফর। দ্বিতীয়বার তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৮ সালে, ব্যক্তিগত সফরে। তখন তিনি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ তাকে কার্যত রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদাই দিয়েছিল। এ সফরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল।
একজন শিক্ষক (বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক) এবং পরে একজন রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবন ছিল প্রায় ৫০ বছরের। ১৯৬৯ সালে যে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, তা শেষ হয় ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
পাঁচবার রাজ্যসভার সদস্য, দু’বার লোকসভার সদস্য ছিলেন তিনি। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান অভিজিৎ কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় ও লোকসভার সদস্য। একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা একজন নৃত্যশিল্পী। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেয়া প্রণব মুখার্জি একজন সফল রাজনীতিবিদ, একজন সফল মন্ত্রী, একজন সফল সংগঠক। বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ- সব জায়গাতেই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং থাকবেনও।
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply